গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হল সংবাদ-মাধ্যম । সমগ্র বিশ্বজুড়ে সংবাদ-মাধ্যমের ভূমিকা আজ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে । বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে পৃথিবী জুড়ে চর্চা হচ্ছে । সম্প্রতি আমেরিকার সেনেটে ভারতীয় সংবাদ-মাধ্যম সম্পর্কে আলোচনা হয় , সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের একটাংশ সরকারের তাবেদারে পরিনত হয়েছে । তারা প্রতিনিয়ত বানোয়াট খবর পরিবেশন করে দেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে । নিঃসন্দেহে এতে আমরা দুঃখিত । কারণ এই ভারতের সংবাদ-মাধ্যম ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করেছিল । ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করার কারণে অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠান হয়েছিল । তবু তাঁদেরকে সরকার বশে আনতে পারেনি । সাংবাদিকতা এমন একটা পেশা যার কাজ হল সরকারকে প্রশ্ন করা । ক্ষমতাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে সঠিক পথে পরিচালনা করা । কিন্ত দুঃখের হল , সত্য ২০১৪ সালের পর থেকে এদেশের সংবাদ-মাধ্যম সরকারকে প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে । তারা আসলে সরকারের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে ।
শুধু মুখপত্র নয় , দেশের সংহতি , সম্প্রীতির ক্ষেত্রে আজকের সংবাদ মাধ্যমে বিপজ্জনক খেলা চলছে । পাকিস্থান , বালাকোট , দেশপ্রেম , হিন্দু-মুসলমান এসবই সংবাদ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে । এরফলে দেশজুড়ে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ছে যা আমাদের সংহতিকে বিপন্ন করছে । এদিকে দেশের মূলস্রোতের ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলি মোদী মিডিয়ায় পরিনত হয়েছে । আরএসএসের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে । আর এতটাই বিপজ্জনক খেলা চলছে আজকের ভারতের ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় যে তারা জনমতকে বিভ্রান্ত করছে । লোকসভা ভোটে মোদীর জয়ের নেপথ্যে মানুষের কতটা অবদান আছে তা জানা না গেলেও মিডিয়ার অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না । ২০১৮ সাল থেকে মোদীকে এমনভাবে মিডিয়াতে তুলে ধরা হতে থাকে যেন মনে হয় তিনি ছাড়া ভারতে আর কেউ নেতা হওয়ার যোগ্য নেই । তুলনামূলক আলোচনা চলতে থাকে রাহুলের সঙ্গে মোদীর । আর কথিত সমীক্ষার নামে বানোয়াট তথ্য পরিবেশন করে মোদীকে এগিয়ে রাখা হয় ।
সরকারের কাছে তার কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা মিডিয়ার প্রধান দায়িত্ব । সেই দায়িত্ব পালন করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সরকারের স্তুতি করতে গিয়ে নির্ল্লজের মতো সরকারের প্রচারের দায়িত্ব পালন করে চলেছে । এখানেই শেষ নয় , নির্বাচনের সময় মানুষকে সঠিক তথ্য পরিবেশন না করে মিথ্যা , কাল্পনিক দেশপ্রেমের তত্ত্ব প্রচার করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছে । যা সংবাদ-মাধ্যমের নীতি-নৈতিকতার বিরোধী । সংবাদ-মাধ্যমের সঞ্চালিকা বা সঞ্চালক যেভাবে টিভি চ্যানেলে বসে বিশেষ মতাদর্শকে প্রচার করছে বা তার পক্ষে আওয়াজ তুলছে তা দেখে আমাদের মত সাংবাদিকদের লজ্জায় মাথানত হয়ে যাচ্ছে ।
সংবাদ-মাধ্যম কতখানি নিচে নামলে এভাবে জনগণের কথাকে মান্যতা না দিয়ে সরাসরি নিজেদের বানোয়াট খবর পরিবেশন করতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানাতে । মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি যে সাফল্য পেয়েছে তার নেপথ্যে রয়েছে মিডিয়ার প্রচারনা । মিডিয়ার প্রচারনায় বিভ্রান্ত হয়ে সাধারন মানুষের ধারণা হয়েছে যে বিজেপির কোনো বিকল্প নেই । তাই বিজেপিকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছে । আর এখানেই শেষ নয় , ওই সব গোদী মিডিয়ায় এক্সিট পোলের নামে যেভাবে এক তরফাভাবে বিজেপিকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে তা শুধু সাংবাদিকতার এথিকসের বিরোধী নয় , তা লজ্জাজনক বললে ভুল বলা হবে না ।
কিন্ত সাধারন মানুষ প্রমাণ করেছে মিডিয়া নয় , তারাই শেষ কথা বলে । দুশোর বেশি আসন পেয়ে মহারাষ্ট্র দখল করবে বিজেপি শিবসেনা যেসব মিডিয়া এসব কথা বলেছিল তাদেরকে মুখের উপর জবাব দিয়েছে মহারাষ্ট্রের মানুষ । মিম নামক বিজেপি বন্ধু রাজনৈতিক দল না থাকলে মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোটের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন অধরা থেকে যেত । তাহলে স্পষ্ট গোদী মিডিয়া মিথা চার করেছে , মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে , গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ।
আর হরিয়ানাতে ওই সব মিডিয়া বলেছিল ৭৫ টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসবে বিজেপি । কংগ্রেস দল নাকি হরিয়ানাতে মুছে যাবে । কিন্ত মানুষের রায়ে কংগ্রেস দ্বিগুন আসন লাভ করেছে , আর বিজেপিকে ক্ষমতায় থাকার জন্য বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক করতে হচ্ছে । এরপরও  গোদী মিডিয়া যদি মানুষের কাছে ক্ষমা না চায় তাহলে মানুষই এদেরকে বয়কট করা শুরু করবে । সংবাদ-মাধ্যমকে গণতন্ত্রের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর না করতে পারে ,তা বলে তাকে দিয়ে মিথ্যাচার করানো শুধু অনৈতিক নয় , অপরাধও বটে ।


Find out more: